প্রজন্মের প্রেরণা, আদর্শের বাতিঘর, ইতিহাসের বাঁকে এক অবিস্মরণীয় নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম রাহিমাহুল্লাহ

আজ ২৩ অক্টোবর তার মৃত্যুবার্ষিকী। গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি অবিচল আদর্শের প্রতীক, অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা এই মহান নেতাকে।

অধ্যাপক গোলাম আযম ছিলেন বিশ্বনন্দিত ইসলামী চিন্তাবিদ, ভাষা আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক জিএস এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপকার। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটি উত্থান-পতনের ঘটনার সঙ্গে তিনি গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের মাটি, আলো-বাতাস ও মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ছিল তাঁর জীবন ও সংগ্রাম। স্বেচ্ছায় দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরে যাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। পঞ্চমবার কারাগারে যাওয়ার আগে গণমাধ্যমের সামনে তাঁর যে বলিষ্ঠ সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন, তা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাছে আজও প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে বিবেচিত। তাঁর চিন্তাচেতনা, সাহসিকতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বাংলাদেশে ছাত্র-যুবসমাজসহ ইসলামপ্রিয় মানুষের কাছে আদর্শ হয়ে থাকবে। তাঁর অমর কীর্তির জন্যই তিনি চিরঅমর হয়ে আছেন।

জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি

অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর, মঙ্গলবার (বাংলা ১৩২৯ সালের ৫ অগ্রহায়ণ) ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত বিখ্যাত দ্বীনী পরিবার শাহ সাহেব বাড়িতে (মিঞা সাহেবের ময়দান নামে পরিচিত) মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গোলাম কবির এবং মায়ের নাম সৈয়দা আশরাফুন্নিসা। পিতামহ ছিলেন মাওলানা আবদুস সোবহান।

শিক্ষা জীবন

তিনি ১৯৩৭ সালে জুনিয়র মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এসএসসি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ১৩তম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৪ সালে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বোর্ডে ১০ম স্থান লাভ করেন।

১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকায় তিনি এম.এ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। ১৯৪৯ সালে দাঙ্গাজনিত অস্থিরতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাও স্থগিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে তিনি এম.এ পরীক্ষা দেন। ঐ বছর কেউ প্রথম বিভাগ পাননি; চারজন ছাত্র উচ্চতর দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন, তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক গোলাম আযম অন্যতম ছিলেন।

কর্মজীবন

১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি সেখানে অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ছাত্র রাজনীতি ও ভাষা আন্দোলন

তিনি ১৯৪৬-৪৭ শিক্ষাবর্ষে ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জি.এস) নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৪৭-৪৮ ও ১৯৪৮-৪৯ দুই সেশনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী তাঁর সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন “রাষ্ট্রভাষার দাবি-সংবলিত স্মারকলিপির খসড়া তৈরির দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছিল। ডাকসুর তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি গোলাম আযম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম মাঠে তা পাঠ করেন এবং ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে লিয়াকত আলী খানের হাতে প্রদান করেন।”

রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনার সময়ও তিনি ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং এ কারণে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। ১৯৫৫ সালেও একই কারণে তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন।

ইসলামী আন্দোলনের সূচনা

ছাত্রজীবন শেষে ১৯৫০ সালেই তিনি তাবলীগ জামায়াতের তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রংপুর জেলার আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে তিনি তমদ্দুন মজলিসের রংপুর জেলা প্রধান হিসেবেও কাজ করেন।

১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে সহযোগী (মুত্তাফিক) সদস্য হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৫৫ সালে রংপুর কারাগারে অবস্থানকালে রুকন হিসেবে শপথ নেন। একই বছরে তিনি রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ও রাজশাহী বিভাগীয় আমীরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।

পরবর্তীতে ১৯৬৯-১৯৭১ মেয়াদে তিনি জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তানের আমীর নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের ডিসেম্বরে তিনি স্বেচ্ছায় মজলিসে শূরার কাছে আবেদন করে আমীরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন।

মৃত্যু

অধ্যাপক গোলাম আযম ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ২৫ অক্টোবর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে লক্ষাধিক মানুষের অংশগ্রহণে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়, ইমামতি করেন তাঁর পুত্র আবদুল্লাহিল আমান আযমী। পরে তাঁকে মগবাজারে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা!